Saturday, September 5, 2009








Image : salik

বিরোধ

আকাশের কালো মেঘ পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে উড়ে যাওয়ার সময় বাধা দিয়ে যায় সূর্যের আলোকে। জন্মদাতার সাথেই তার ঘোর বিরোধ, একা একা সূর্য সারা জীবন পৃথিবীকে শাসন করবে তা মেনে নিতে পারেনা। তাই তার দখল দারিত্ব বুঝাতে ঝড় হয়ে দুনিয়ার বুকে চালায় নির্মম ধ্বংস যজ্ঞ। এক অপরের পরম শত্র“ কেউ কাউকে ছাড় দিতে চায় না, শেষ পর্যন্ত দাপটী সূর্য ক্ষণজন্মা মেঘের কাছে পরাজয় বরণ করে। ঝড়ের দাপটে উড়ে যায় ঘর-বাড়ী, গরু-ছাগল ক্ষতি হয় গাছপালা সহ অগণতি জীবের। ঝড়ের ভিতর ঝড়কে নিয়ে ভাবতে ভাল লাগছে মিতার, ছাদের উপর রেলিং শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। ছাদ থেকে পড়ে যেতে পারে কিংবা উড়ে যেতে পারে বৈশাখের কালো থাবায়। অদ্ভূত এক আনন্দে শিহরিত হয়, কালো পরিবেশের সাথে তার শরীর-মন এক হয়ে যায়। এমনিতেই মিতা কালো তারপরেও ঘনসন্ধ্যার মত হয়েগেছে বিকালটা হাতদুটি চোখের সামনে আনার পরও মিতা তার হাত দেখতে পারছিলনা। ইচ্ছা করে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে প্রকৃতির সাথে একত্মতা ঘোষণা করতে। আলোর বিপক্ষে যাওয়ার যে শান্তি তা প্রথম উপলব্ধি করল। এতদিন সে কুকড়ে থাকতো নিজের ভিতর সবার সাথে ভাল ভাবে মিশতে পারতনা। আর সবাই তার সাথে মনখুলে মিশতনা। মিতার চেহারা খারাপ না তারপরেও কালো বলে তার বন্ধু-বান্ধবী নাই বললেই চলে। ছাত্রী ভালো বলেই তার ক্লাস মেটরা তার কাছ থেকে শুধু নোট নিতে আসে মনখুলে তার সঙ্গে মেশেনা। তুলতুলে শরীরের বিলাতী বিড়াল বিদেশ থেকে আসার সময় মিতার বাবা মিতাকে এনেদিয়েছিল বাড়ীতে থাকলে ওই বিড়ালটাই মিতার সঙ্গী। মামার দেয়া ল্যাপটপ, তার সকল একাকীত্ব ভুলে ডুবে থাকে তার ভিতরে কলেজের ক্লাস ছাড়া প্রায় সব সময়ই সে ল্যাপটপের মাধ্যমে বন্ধুত্ব তৈরী করে অদেখা অজানা ইন্টারনেট ব্রাউজকারীদের সাথে। এই হিসাবে মিতার বন্ধুর সংখ্যা অনেক কিন্তু তাদের চাইলেই মিতা কাছে পায় না। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো অবস্থা। এদের সাথে কথা বলে কিন্তু কখনো ওয়েব ক্যাম ব্যবহার করেনা মিতা। অনেকে অনুরোধ করে ওকে ওয়েব ক্যাম চালু করতে। ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয়েছে ফরহাদের সাথে ওর সাথে মোবাইলেও কথা হয়। কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে পড়াশুনা করে বড় প্রোগ্রামার হওয়ার। মিতার কাছে খুব ভাল লাগে ফরহাদ আগ বাড়িয়ে কখনও মিতার পরীচয় কিংবা কি করে তা জানতে চায়নি কখনও, ফরহাদ প্রশ্ন করে কখনও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেনি কিংবা মিতাকে দেখার জন্য কখনো অনুরোধ করেনি। ওর সাথে পরিচয় প্রায় দেড়বছর হতে চলল ফরহাদের সাথে আড্ডার বিষয় সমাজের অসংগতি গুলো নিয়ে। সমাজ নিয়ে ভাবতে ও গল্প করতে ফরহাদ খুব ভালোবাসে। আমিও চাইনা ফরহাদ আমাকে দেখার জন্য অনুরোধ করুক। ক্লাসের পড়াশুনা শেষ করার পর রাতে ফরহাদের জন্য বরাদ্দ করা থাকে। আর এই সময় কেউই সাধারণত আমার রুমে আসে না, এমনকি বাবা-মাও সেই সময় আসেনা করাণ বাবা ব্যবসার কাজে বেশীর ভাগ সময়ই বাইরে থাকে। আর মা আছে তার বন্ধু-বান্ধবী আর পার্টি নিয়ে। একাকিত্ব তার সেই ছোট বেলা থেকেই, বড় হয়েছে মিতা আয়া-বুয়াদের কাছে। বাড়ীতে কাজের লোকের অভাব থাকত না তারপরেও তারা সবাই যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতো আর মা ঘরে থাকলে হয় টেলিফোন কিংবা কোন বান্ধবীর সাথে আড্ডা দিয়ে সময় পার করত। স্বাধীনভাবে সে ঘুরতে পারতনা বাড়ী থেকে সে গাড়ীতে করে স্কুলে যেত স্কুল শেষ হলে আবার গাড়ীতে করে বাসায় ফিরে আসত তার বন্ধী জীবনে। একঘেয়েমী জীবন অক্টোপাসের মতো তাকে আষ্টে পিষ্টে বেঁধে ফেলেছে। মিতা দিগন্তের মত বিশাল হতে চায় যেখানে আকাশটা মিশে গেছে। যেখানে সাদা কালোর কোন তফাত নাই, কিংবা ধনী-গরীব বলে কিছুই নাই। যেখানে দিনের আলো আর রাতের অন্ধকার অনাআয়েশে প্রবেশ করতে পারে কোন বিরোধ থাকে না তাদের মধ্যে। একটার পর একটা সুন্দর সমন্বয় রক্ষা করে ঢুকে পড়ে এই পৃথিবীর বুকে। রাত্রীকে ছাড়া দিন অচল আবার দিনকে ছাড়া রাত্রী মূল্যহীন। তারপরেও কেন আমাদের সমাজের মানুষদের মধ্যে এই ভেদাভেদ ধনী-গরীব, উঁচু-নিচু, সাদা-কালো। দাসপ্রথার যুগ শেষ হলেও তার মুলমন্ত্র যা ছিল তা এখন নতুন রূপে নতুন আকারে নতুন আঙ্গিকে আমাদের মধ্যে বহমান। এযেন পৃথিবীর তিনভাগ জলের মত মানব ইতিহাসে বাস্তব সত্য কোন যুগেই এর মূল উৎপাট হয়নি বা কেউ করতে পারেনি। আধুনিক যুগে চলছে একজন আরেক জনকে হেয় প্রতিপন্ন করার ঘৃণ্য মনমানসিকতা যা দাসপ্রথার যুগ থেকেও খারাপ। দাসপ্রথার যুগে মনিব ভৃত্যর উপর শাররীক অত্যাচার করতো। কিন্তু এখন মানসিকভাবে অত্যাচার করা হয় পথে-ঘাটে, রাস্তায়, বাসায়, অফিসে, আদালতে। মানবিকতা এখন চরম বিপর্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে আমাদের আমিত্বের, আমাদের অহংবোধের পরিবর্তন করতে হবে। এযেন গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। আমাদের পৃথিবীটা আজ কেঁদে চলেছে, আমাকে মুক্তি দাও, মুক্তি দাও বলে। সেই কান্না ফরহাদের হৃদয়ে যেন প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে আমার কাছে। ফরহাদের সাথে পরিচয় না হলে চিন্তার গভীরে আমি ডুব দিতে পারতাম না, জানতে পারতাম না আমাদের ত্র“টি-বিচ্যুতির কথা হয়ত রাগে ক্ষোভে একদিন আত্মহত্যা করতাম কিংবা নেশাদ্রব্য গ্রহণ করে অনাবিল আনন্দের রাজ্যে রাজরাণী হয়ে থাকাতাম ভুলে যেতাম আমার চারপাশের অসহায় পৃথিবীর আর্তনাদ। চিন্তা গভীর সমুদ্রে শ্যাওলা হয়ে পানির উপরে আমার অসহায়ত্ব নিয়ে ভেসে ভেসে হয়রান হতাম আর আমার ভাগ্যকে দোষ দিতাম। অনেক মানুষ আছে যাদের বাড়ী, গাড়ী নেই বাবা, মা নেই এই সমাজে পরিচয় দেয়ার মত নাই কোন সম্বল। তাদের অবস্থা তো আমার থেকেও খারাপ আমাকে আশ্বাস দেয় ইন্টারনেটের বন্ধুরা কিংবা ফরহাদ। কিন্তু ওদেরকে কে দেবে আশ্বাস, জীবনের মানে খুঁজতে শেখাবে। তোমাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে যারা তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও। কোমর সোজা করে ওদের অহংবোধের উপর আঘাত হান। আর তা করতে গিয়ে কোন রক্তপাতের প্রয়োজন নেই। তোমরাও জানিয়ে দাও এই পৃথিবীতে তাদের গুরুত্ব যেমন তোমাদের গুরুত্ব তেমনি। গরীব, কালো, নির্যাতিত বলে আমাদের অবহেলা করবে তা কখনই হতে দেয়া যাবে না। আর এর জন্য দরকার মানবিক শিক্ষার- শুদ্ধজ্ঞানের। এখনকার ব্ল্যাকবোর্ড শিক্ষিতরা বোঝে কী করলে কত টাকা ইনকাম করা যাবে। কোন বিষয় নিয়ে পড়লে চাকরীর বাজারে সুবিধা করা যাবে। আবার সৃষ্টিশীল পেশা যেগুলো সেগুলোতে সৃষ্টিশীল মন মনাসিকতার পরিবর্তে জায়গা করে নিয়েছে অর্থ আর খ্যাতি। যতনা সৃষ্টির জন্য শিল্প চর্চা করা তার থেকে বেশী অর্থ আর খ্যাতির জন্য। আর এরা নাকি সমাজ বদলের রূপকার এদের মাধ্যমে অপারাধের বোধ জাগ্রত হয়, হায় এখনকার আধুনিক শিল্পীরাও অন্ধ হয়ে গেছে। শিল্পীরা যখন অন্ধ তখন আইন-কানুন, সমাজ, সংস্কৃতি, মানবতা বোধ একপেশে হয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। পৃথিবী কাঁদবে, মানবতা কাঁদবে, সমাজ কাঁদবে, সংস্কৃতি কাঁদবে ঢুকরে ঢুকরে কাঁদবে কেউ চোখের পানি মুছে দিতে আসবে না কারণ তখন আর পানি মুছিয়ে দেয়ার সময় থাকবে না। আর এই সব কথাগুলো ফরহাদের কাছে শুনতে ভালই লাগে স্বপ্নে ঘোরে চলে যাই, দুইজন একটা নতুন পৃথিবী গড়ার শপথ নেই। দুই জন মনে হয় আমরা নতুন পৃথিবী গড়ার সৈনিক। আমরা দুইজনই এই সমাজ বদলানোর জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমাদের চ্যাটিং চলে সারা রাত। ও যেন পথ হারা সাগরে ঘুরপাকা খাওয়া জাহাজের ক্যাপ্টনের মত দায়িত্ব নিয়ে সহকর্মীকে দিকনির্দেশনা বুঝিয়ে দেয় । কিন্তু ফরহাদ কখনও প্রশ্ন করেনা শুধু আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যায়। ওর কাছ থেকে নির্যাতন, নিপিড়নের তথ্য পেয়ে আমার মনে জমে থাকা এতদিনের দুঃখ সব ভুলে যাই। স্বপ্ন দেখি নতুন পৃথিবীর, কচি সবুজে ঝলমলে হেসে উঠা পৃথিবী, যেখানে সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করে উঠবে সকালে। আর রাতের অন্ধকারে চাঁদের জোৎসনায় শরীর ধুয়ে পবিত্রতা ছড়িয়ে দিবে সবার মাঝে। শান্তিতে ঘুমাতে যাবে সবাই কোন তাড়া হুড়া থাকবেনা সেই ঘুমে ভিতর। কর্মব্যস্ততা থাকবে কিন্তু থাকবেনা তার বাড়াবাড়ি যা মানুষকে পাথর করে দেয় মায়ামমতাহীন, ভালবাসাহীন, শ্রদ্ধাহীন, ভক্তিহীন একটি জড়পদার্থ।

Bijoy 2023